দেশের প্রায় সব কর্মক্ষেত্রে নারীরা মাতৃত্বকালীন ছুটি পেলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত বিবাহিত বা অন্তঃসত্ত্বা শিক্ষার্থীরা এখনো এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত। গর্ভাবস্থার মতো সংবেদনশীল সময়েও তাদের ক্লাস, পরীক্ষা, প্রেজেন্টেশন ও ল্যাবের কাজ চালিয়ে যেতে হয়। এতে শারীরিক ও মানসিক চাপে তারা নানা সমস্যায় পড়েন।
বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বিষয়টি
নিয়ে কথা বলে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ে মাতৃত্বকালীন ছুটি না থাকায় তারা নানা সমস্যায় পড়েন। উপস্থিতির কঠোরতা ও সেমিস্টার ড্রপের ভয়, শারীরিক-মানসিক চাপ, ব্রেস্টফিডিং ও শিশুসেবার সুযোগের অভাব তাদের জীবনে বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে। তারা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে মাতৃত্বকালীন ছুটি নীতিমালা, বিশেষ পরীক্ষা ব্যবস্থা, ব্রেস্টফিডিং কর্নার ও প্রশাসনের সংবেদনশীলতার দাবি জানিয়েছেন।রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ফারজানা আক্তার লিমা বলেন, “প্রসবের আগে অন্তত এক মাস এবং প্রসবের পর অন্তত পাঁচ-ছয় মাস মায়ের বিশ্রামের প্রয়োজন। এই সময়টায় নিয়মিত ক্লাসে থাকা বা পরীক্ষায় অংশ নেওয়া সত্যিই কঠিন। বাচ্চাকে সামলানো, ক্লাসে যাওয়া, আবার শিশুকে খাওয়ানোর জন্য ঘন ঘন বিরতি নিতে হয়, সব মিলিয়ে মানসিকভাবে প্রচণ্ড চাপ তৈরি হয়। আমাদের মতো শিক্ষার্থীদের জন্য যদি প্রসবের এক মাস আগে এবং সন্তান জন্মের পরবর্তী পাঁচ মাস ছুটি দেওয়া হয়, তাহলে এটি অনেক বড় সহায়তা হবে।”
“এতো এতো চারপাশের প্রেসারে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ি, মাঝে মধ্যে মনে হয়েছে সুইসাইড করি। এটেন্ডেন্স কনসিডার করার জন্য লজ্জায় বলতে পারতাম না যে এই এই সমস্যা। বেশিরভাগ প্রফেসর লেভেলের শিক্ষকরা এসব বিষয়ে একটার চেয়ে দুইটা কথা বলা যায়না। পর্যাপ্ত প্রমাণ দিয়েও ছুটি মেলেনি। ফলে সন্তানকে ঠিকভাবে ব্রেস্টফিড করাতে না পারায় এখন সে খাবার ভুলে গেছে,” এমন অভিজ্ঞতার কথা জানালেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের ২০২১–২০২২ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী উম্মে হাবিবা মিথিলা।
তিনি আরও বলেন, “যদি বিশ্ববিদ্যালয়ে মাতৃত্বকালীন ছুটি কনসিডার করা হয়, তাহলে মেয়েরা অন্তত কিছুটা স্বস্তি পাবে, কারণ গর্ভাবস্থা ও সন্তান জন্মের পর তারা কঠিন মানসিক ট্রমার মধ্য দিয়ে যায়।”
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অর্থনীতি ও গ্রামীণ সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী মোছা. মোতমাইন্না শিলা বলেন, “আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা মানেই প্রতিদিন ল্যাব, ফিল্ডওয়ার্ক ও প্র্যাকটিক্যাল সামলানো। এই চাপের মধ্যে গর্ভবতী শিক্ষার্থীদের সব দায়িত্ব পালন করা অসম্ভবের কাছাকাছি। উপস্থিতির নিয়ম, পরীক্ষা, ও ফিল্ডওয়ার্কের চাপে তারা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি মাতৃত্বকালীন ছুটি বা কোর্স ফ্রিজের সুযোগ দেওয়া হয়, তাহলে গর্ভকালীন ঝুঁকি কমবে, শিক্ষাজীবনও ব্যাহত হবে না।”
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী কামরুন নেছা নুসরাত বলেন, " আমার সিজারিয়ান অপারেশনের মাত্র ১২ দিনের মাথায় আবার পরীক্ষা দিতে হয়েছিল। তখন হাঁটতেও কষ্ট হচ্ছিল। তবু পরীক্ষা দিতে হয়েছে উপস্থিতির কারণে। প্রসব-পরবর্তী সময়ের যন্ত্রণা, বাচ্চাকে বাড়িতে রেখে ক্লাসে আসা, সব মিলিয়ে মানসিকভাবে সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছিলাম। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো ব্রেস্টফিডিং কর্নার নেই, যা অন্তত কিছুটা স্বস্তি দিতে পারত। এসব কারণে অনেক মেয়ে উচ্চশিক্ষা শেষ না করেই বিয়ে বা সন্তান নেওয়া থেকে বিরত থাকে।”
জানা যায়, ভারতের কেরালার মহাত্মা গান্ধী বিশ্ববিদ্যালয় (এমজেইউ) শিক্ষার্থীদের জন্য ২০২২ সালের ডিসেম্বরে চালু করেছে তিন মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘোষণায় বলা হয়, অনার্স ও পোস্টগ্র্যাজুয়েট পর্যায়ের ১৮ বছর বা তার অধিক বয়সী শিক্ষার্থীরা গর্ভকালীন পরিস্থিতিতে কোর্স চলাকালীন একবার বা দুবার তিন মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটি নিতে পারবেন। এবং ২০২৩ সালে কেরালা বিশ্ববিদ্যালয়ও মেয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য ঘোষণা দিয়েছে ছয় মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটি। তাদের নিয়ম অনুযায়ী, ১৮ বছরের বেশি বয়সী ছাত্রীদের প্রসবের আগে বা পরে ছয় মাস পর্যন্ত ছুটি নেয়ার সুযোগ থাকবে।
এছাড়াও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও মাতৃত্বকালীন ছুটি চান। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ২২ জুন উপাচার্য বরাবর মাতৃত্বকালীন ছুটিসহ পাঁচটি দাবি উল্লেখ করে স্মারকলিপি দেন শিক্ষার্থীরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদ (ডাকসু)-এর কার্যনির্বাহী সদস্য ও বাংলাদেশ ইসলামি ছাত্রীসংস্থা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভানেত্রী সাবিকুননাহার তামান্না বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে মাতৃত্বকালীন ছুটি নিশ্চিতের দাবি জানিয়েছেন। তিনি বলেন, “আমিও মেয়েদের এ সমস্যা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করেছিলাম। কিন্তু কিভাবে সময় মেলানো যায় সেটা মিনিমাইজ করা যাচ্ছেনা। মাতৃত্বকালীন ছুটি অবশ্যই থাকা উচিত। এই সুবিধা না থাকায় অনেক শিক্ষার্থী সন্তান নিতে অনাগ্রহ প্রকাশ করছেন। সন্তান জন্মের পর কীভাবে পড়াশোনা ও শিশুকে সামলানো হবে এমন সংকটে পড়ে অনেকেই ক্লাস মিস করতে বাধ্য হন। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিশুসেবা কেন্দ্র না থাকায় মা-শিক্ষার্থীদের জন্য ক্লাসে উপস্থিত হওয়াও কঠিন হয়ে পড়ে।”
তামান্না আরও বলেন, “গর্ভাবস্থার শেষ তিন মাস ছুটি না হলেও অন্য উপায়ে সুযোগ-সুবিধার পাশাপাশি অসুস্থ অবস্থায় পরীক্ষার আলাদা ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন।”
হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ধ্রীতি সাহা বলেন, “আমাদের সেমিস্টার খুব ছোট সময়ের মধ্যে শেষ হয়ে যায়। সন্তান জন্মের সময় কোনো ছুটি না থাকলে আমাদের বাধ্য হয়ে সেমিস্টার ড্রপ দিতে হয়। মাতৃত্বকালীন ছুটি থাকলে সন্তান জন্মের পরও আমরা পড়াশোনায় ফিরতে পারব। এতে সন্তান লালনপালনের পাশাপাশি শিক্ষাজীবনও ব্যাহত হবে না।”
তিনি আরও বলেন, “মাতৃত্বকালীন সহায়তার জন্য প্রতিটি ফ্যাকাল্টিতে ফিডিং জোন স্থাপন, গর্ভবতী ও নবমাতাদের জন্য বিশেষ অথোরিটি বা হেল্প ডেস্ক রাখা জরুরি।"
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী শাম্মি আক্তার মিথি বলেন, “বিবাহিত শিক্ষার্থীদের পরিবার ও পড়াশোনার ভারসাম্য রাখা কতটা কঠিন। সন্তান প্রত্যাশার সময় এই চাপ আরও বেড়ে যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে মাতৃত্বকালীন ছুটি বা একাডেমিক নমনীয়তার অভাবে অনেকেই বাধ্য হয়ে পড়াশোনা ছেড়ে দেন। প্রশাসন যদি এই বাস্তবতা স্বীকার করে নারী-সহায়ক ব্যবস্থা নেয়, তাহলে উচ্চশিক্ষা আরও মানবিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক হবে।”
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল সেন্টারের ডেপুটি চিফ মেডিকেল অফিসার ও গাইনী বিশেষজ্ঞ ডা. মাহমুদা আক্তার মুক্তা বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনার চাপ ও শারীরিক পরিবর্তনের কারণে গর্ভকালীন সময় শিক্ষার্থীদের জন্য কষ্টকর। বিশেষ করে সিজারিয়ান মায়ের ক্ষেত্রে অন্তত তিন মাসের বিশ্রাম প্রয়োজন। তাই মা হওয়ার পর অন্তত তিন মাসের বিশেষ ছুটি থাকা উচিত, যাতে তারা শারীরিকভাবে সুস্থ হয়ে পড়াশোনায় ফিরতে পারেন।”
বাংলাদেশ জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের উপ-পরিচালক ফারহানা সাঈদ বলেন, "আমাদের দেশের বাস্তবতায় অনেক নারী শিক্ষার্থীরা কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন বিয়ে করেন এবং সন্তান ধারন করেন। কাজেই, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের মাতৃত্বকালীন ছুটির আওতায় আনা প্রয়োজন। ফিনল্যান্ড, জার্মানিসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশের পাশাপাশি এশিয়ার বিভিন্ন দেশ যেমন চীন, দক্ষিন কোরিয়ায় শিক্ষার্থীদের জন্য মাতৃত্বকালীন ছুটি রয়েছে। আমাদের দেশে নারীরা বাচ্চার পরিচর্যা করার কারনে নিজের উচ্চশিক্ষা বা ক্যারিয়ার স্যক্রিফাইস করেন, যা নারীর ক্ষমতায়নে অন্যতম চ্যালেঞ্জ। তাই, পদ্ধতিগত কিছু পরিবর্তন করে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে মানসম্মত চাইল্ড কেয়ার বা শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র ও ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার স্থাপন করা যেতে পারে।"
এছাড়াও বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় রংপুর, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরও কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও একই দাবিগুলো উত্থাপন করেছেন।
৯ দিন আগে রবিবার, ডিসেম্বর ১৪, ২০২৫
