অসংখ্য শিক্ষানবিশ আইনজীবীদের নিকট হতে প্রায় ৫০ লক্ষাধিক টাকা হাতিয়ে নেওয়া ভূয়া আইনজীবী সহযোগীসহ র্যাবের হাতে গ্রেফতার হয়েছে।
গ্রেফতার হওয়া দুইজন হলেন কুমিল্লা নগরীর ঝাউতলা এলাকার মো: শামসুল হকের ছেলে প্রতারক মোঃ এহতেশামুল হক@ এ্যাডভোকেট নোমান (৩৪) ও বুড়িচং উপজেলার বাহেরচর গ্রামের মহসীন ভূইয়ার ছেলে জাহিদ হাসান ভূইয়া (২১)। এসময় তাদের নিকট হতে বিপুল পরিমাণ ভুয়া ভিজিটিং কার্ড,
আইনজীবীর মতো মহান পেশাকে পুঁজি খাটিয়ে প্রায় অর্ধকোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া এক প্রতারককে গ্রেফতার করেছে র্যাব-১১, কুমিল্লা যে কিনা আইনের জ্ঞান সম্পর্কে অবগত না অথচ জনসমাজে আইনজীবী হিসেবে পরিচিত। দেখে নেওয়া যাক তার প্রতারণার কৌশল। গ্রেফতারকৃত আসামী মোঃ এহতেশামুল হক @ এ্যাডভোকেট নোমান (৩৪) জন্মগ্রহণ করেন ১৫ আগষ্ট ১৯৮৮ সালে। ২০০৫ সালে এসএসসি পাশ করেন, ২০০৭ সালে কারিগরি থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে ০১ বিষয়ে অকৃতকার্য হওয়ার পর পরবর্তীতে ২০০৮ সালে উত্তীর্ণ হন। পরবর্তীতে ২০০৯ সালে ঢাকার একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে ফ্যাশন ডিজাইন এ ভর্তি হন এবং ২০১১ সাল পর্যন্ত সেখানেই পড়াশোনা করেন। পড়াশোনায় নিজের অক্ষমতার দরুন সেখান থেকেও ছিটকে পড়েন এবং ২০১৪ সালে ০৩ লক্ষ টাকার বিনিময়ে জনৈক ফারুক নামের এক ব্যক্তির নিকট হতে আইন বিষয়ে অনার্স উত্তীর্ণ সার্টিফিকেট সংগ্রহ করেন। পরবর্তীতে নোমান তার পরিচিত বন্ধু কাউসারের মাধ্যমে ২০১৫ সালে কুমিল্লা কোর্টে কর্মরত জনৈক আইনজীবীর একটি কোচিং সেন্টার ভর্তি হন। উক্ত আইনজীবীর যাবতীয় কাজ সম্পাদন করার জন্য একজন লোকের প্রয়োজন হতে তিনি নোমানকে তার নিজের অধীনে নিয়োগ করেন এবং নোমান তার অধীনে কুমিল্লা কোর্টে কাজ শুরু করে। ২০১৬ সালের প্রথম দিকে নোমান পায়ের ব্যাথায় অসুস্থ হয়ে পড়লে ০৬ মাস কর্মবিরতিতে থাকে এবং ০৬ মাস পর জনৈক আইনজীবির নিকট গেলে তিনি নতুন একজনকে তার স্থলে নিয়োগ করেছেন মর্মে নোমানকে অবগত করেন। ২০১৭ সালে নোমান ঐ কোর্টেই কর্মরত অন্য একজন আইনজীবীর অধীনে কাজ করতে থাকে। পরবর্তীতে একই সালে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সদস্যপদ লাভের আশায় বার কাউন্সিল পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে অকৃতকার্য হন এবং অনিয়মিতভাবে কোর্টে কাজ করতে থাকেন। ইতিমধ্যে নোমান মুসলিম বিবাহ সম্পাদন সহ অন্যান্য আইনী কার্যক্রম মোটামুটিভাবে রপ্ত করে ফেলেন ও কর্মক্ষেত্রে তার প্রতিফলনও ঘটায়। ২০২১ সালে সে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সদস্যপদ লাভের আশায় বার কাউন্সিল পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন এবং পুনরায় অকৃতকার্য হন।
মূল ঘটনা মূলত শুরু হয় ২০২২ সালের প্রথম থেকেই। কোর্টের যাবতীয় কর্মকান্ডে নোমানের যথেষ্ট জ্ঞান অর্জনের পর সে মোটা অংকের টাকা উপার্জনের পথ খুজতে থাকে। ইতিমধ্যে সে নিজের নামে একটি ভুয়া এ্যাডভোকেট কার্ড ও মানবাধিকার কার্ড তৈরী করে ফেলে। পরবর্তীতে নোমান তার বন্ধু কাউসারের মাধ্যমে পরিচিত হয় ভিকটিম মোঃ রেজাউল করিম খান (৩৩) এর সাথে। ভিকটিম রেজাউল পেশায় একজন শিক্ষানবিশ আইনজীবি হওয়ায় কোর্টে যাওয়া আসা ও কাজ করার সময় প্রতারক নোমানের সাথে পরিচিত হয়। এরই মধ্যে প্রতারক নোমান ভিকটিমকে তার ভুয়া এ্যাডভোকেট কার্ড ও মানবাধিকার কর্মীর কার্ড দেখিয়ে তার বিশ্বস্ততা অর্জন করে ফেলে ও নিজেকে আসল আইনজীবী বলে তার কাছে পরিচয় দেয়। নোমান ভিকটিমকে বাংলাদেশ বার কাউন্সিল পরীক্ষার এমসিকিউ পর্বে পাশ করিয়ে দেওয়ার আশ্বাস দিলে ভিকটিমের নিকট তার কথা গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়। ভিকটিম তার পরিচিত অন্যান্য শিক্ষানবিশ আইনজীবীদের বাংলাদেশ বার কাউন্সিল পরীক্ষার এমসিকিউ পর্বে পাশ করিয়ে দিতে পারবে মর্মে তার এক পরিচিত এক আইনজীবীর বিষয়ে অবহিত করলে তারা সকলে একমত পোষণ করে ও টাকা প্রদানে রাজি হয়। এছাড়াও নোমান বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট বার এ্যাসোসিয়েশনে কর্মরত তার পরিচিত এক উচ্চপদস্থ আইনজীবী আছে যে কিনা তাদেরকে সকল পরীক্ষায় পাশ করিয়ে দিতে পারবে এবং শুধুমাত্র হোয়াটস এ্যাপ চ্যাটের মাধ্যমেই তার সাথে যোগাযোগ সম্ভব মর্মে ভুক্তভোগীদের নিকট তথ্য প্রকাশ করে ও উক্ত আইনজীবীর সাথে যোগাযোগের জন্য নোমান তাদেরকে একটি নাম্বার প্রদান করে যেটি কিনা ছিল নোমানের নিজের আরেকটি নতুন নাম্বার যেটি মোবাইলে সেভ করলে হোয়াটস এ্যাপের আইকোনে ইধৎ ঈড়ঁহপরষ নামে প্রতীয়মান হত। ভুক্তভোগীরা উক্ত হোয়াটস নম্বরে মেসেজ প্রেরণ করলে নোমান নিজেই উচ্চপদস্থ আইনজীবী সেজে তাদের সকল মেসেজের ফিডব্যাক প্রদান করত ও তাদেরকে বিভিন্নভাবে আশ্বস্ত করত। ইতিমধ্যে ভিকটিম পরীক্ষায় পাশ করার আশায় নিজে ও অন্যান্য শিক্ষানবিশ আইনজীবী কর্তৃক প্রদানকৃত সর্বমোট ৬,৪০,০০০/- টাকা প্রতারক নোমানকে প্রদান করে। টাকা প্রদানের পরিমান, টাকা প্রদানের জায়গাসহ অন্যান্য কথোপকথন প্রতারক নোমান অন্য একটি হোয়াটস এ্যাপ নম্বরের মাধ্যমে সম্পাদন করত ও এর সফটকপি তার নিজ কম্পিউটারে সংরক্ষন করে রাখত। ইতিমধ্যে এমসিকিউ পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হলে ০২ জন শিক্ষানবিশ নিজের যোগ্যতায় কৃতকার্য হয়। কিন্তু নোমান বিষয়টি তার নিজের কৃতিত্বের মাধ্যমে সম্পাদন করেছে বিধায় ঐ ০২ জন শিক্ষানবিশ কৃতকার্য হয়েছে বলে অন্যান্য শিক্ষানবিশকে অবহিত করে। এমতাবস্থায় এমসিকিউ পরীক্ষার ফলাফলে নোমানের নিকট টাকা প্রদানকৃত ০২ জন শিক্ষানবিশ আইনজীবী কৃতকার্য হওয়ার বিষয়টি অন্যান্য শিক্ষানবিশ আইনজীবীরা বিষয়টি জানতে পারলে তাদের কাছেও বিষয়টি আসল বলে প্রতীয়মান হয় ও তারাও টাকা দেওয়ার জন্য রাজি হয়। পরবর্তীতে লিখিত পরীক্ষায় অংশগ্রহণ না করে ভুক্তভোগীদেরকে পাশ করিয়ে দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে প্রতারক নোমান ভিকটিম রেজাউল ও অন্যান্য শিক্ষানবিশ আইনজীবীদের নিকট হতে আরো ১৫,৫০,০০০/- টাকা দাবী করলে ভুক্তভোগীরা পাশের আশায় উক্ত টাকা ভিকটিম রেজাউলকে প্রদান করে এবং রেজাউল তা প্রতারক নোমানকে প্রদান করে। টাকা প্রদানকৃত মোট ১৭ জন শিক্ষানবিশ আইনজীবীদের মধ্যে মাত্র ০১ জন পাশ করলে ভিকটিমদের মধ্যে সন্দেহের উদ্রেগ হয়। তখন তারা প্রতারক নোমানকে বিষয়টি অবগত করলে প্রতারক নোমান জানায় ১৫/২০ দিন পর প্রকাশিত পেন্ডিং ফলাফলে তাদের নাম আসবে ও তারা সবাই কৃতকার্য হবে। উপরন্তু পেন্ডিং ফলাফলে কৃতকার্য হওয়ার জন্য নোমান পুনরায় তাদের কাছে মোটা অংকের টাকা দাবী করে। পেন্ডিং ফলাফলে কৃতকার্য হওয়ার আশায় নোমান ভিকটিমদের নিকট হতে আরো ২২,১০,০০০/- টাকা গ্রহণ করে। পরবর্তীতে পেন্ডিং ফলাফলে কেউই কৃতকার্য না হলে ভিকটিমরা বুঝতে পারে তারা প্রতারণার স্বীকার হয়েছে। এমতাবস্থায় তারা তাদের প্রদানকৃত টাকা ফেরত পাবার জন্য প্রতারক নোমানের বাসায় গেয়ে নোমান জানায় সে তাদের প্রদানকৃত টাকা ফেরত দিয়ে দেবে। যেহেতু শিক্ষানবিশ আইনজীবীদের প্রদানকৃত সমস্ত টাকা রেজাউল সংগ্রহ করে নোমানকে প্রদান করেছে তাই রেজাউল ও অন্যান্য শিক্ষানবিশদের মধ্যে দ্বন্দ সৃষ্টির লক্ষ্যে নোমান তার শ্যালক জাহিদ হাসান ভূইয়া (২৫) কে বার কাউন্সিলের আইনজীবী পরিচয় দিয়ে তাদের সাথে কথা বলতে বলে। নোমানের পরিকল্পনা অনুযায়ী জাহিদ শিক্ষানবিশদের সাথে যোগাযোগ করে। যেহেতু লেনদেনের সূত্রপাত হয় রেজাউলকে দিয়ে তাই শিক্ষানবিশরা সম্পূর্ণ টাকা রেজাউলকে দেয় নোমানকে প্রদান করার জন্য ও নোমান টাকাগুলো জাহিদকে প্রদান করার কথা থাকলেও জাহিদ সম্পূর্ণ টাকা পাওয়ার বিষয়ে অস্বীকার করে এবং তাদেরকে জানায় হয়তো নোমান সব টাকা রেজাউলের নিকট হতে বুঝে পায় নাই তাই সে তাকে সব টাকা দিতে পারে নাই। সে আরো জানায় তাকে প্রতিটা কাজের জন্য মাত্র ৭০ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়েছে এজন্যই সে তাদের কাজগুলো করতে পারে নাই। তাদের কাজগুলো সম্পাদনের জন্য আরো টাকা প্রয়োজন বিধায় সে আরো টাকা দাবী করে। তখন শিক্ষানবিশরা জানায় তারা সম্পূর্ণ টাকা রেজাউলকে দেয় নোমানকে প্রদানের জন্য। তখন জাহিদ বলে সে নোমানকে ভালভাবে চেনে, নোমান কখনো তার টাকা আত্নসাৎ করবে না, টাকা আত্নসাৎ করলে রেজাউল ই করবে। এছাড়াও সে শিক্ষানবিশদেরকে রেজাউলের নিকট হতে টাকা উদ্ধার সহ নোমানকে টাকা ফেরত প্রদানের জন্য চাপ দিতে নিষেধ করে। উপরন্তু যদি তারা নোমানকে অতিরিক্ত চাপ দেয় তবে তারা যেন কোনদিন আইনী পেশায় নিয়োজিত না হতে পারে সে ব্যবস্থা করে দেওয়ার হুমকি প্রদান করে। এমতাবস্থায়, শিক্ষানবিশ আইনজীবীরা ব্যাংক হতে লোন গ্রহণ ও ঋণের মাধ্যমে সংগ্রহকৃত টাকা প্রদানের ফলে পরিবার, সমাজ হতে হতাশাগ্রস্থ ও দুর্দশাগ্রস্থ হয়ে পড়ে এবং কোন দিশা না পেয়ে গত ০৩ মার্চ র্যাব-১১, কুমিল্লা বরাবর একটি অভিযোগ দায়ের করেন।
র্যাব-১১, সিপিসি-২, কুমিল্লা উক্ত প্রতারক ও তার সহযোগীকে শনাক্ত ও গ্রেফতার করতে গোয়েন্দা নজরদারী বৃদ্ধি করে এবং মাঠ পর্যায়ে ছায়া তদন্ত শুরু করে। গোয়েন্দা সূত্র হতে প্রাপ্ত তথ্য ও তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় উক্ত প্রতারক ও তার সহযোগীকে চিহ্নিত করার নিমিত্তে একাধিক টীম মাঠ পর্যায়ে কাজ শুরু করে।
ছায়া তদন্তের প্রাপ্ত তথ্য ও তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় গত ২৬ মার্চ রাতে কুমিল্লা সদরের ধর্মসাগর এলাকা হতে প্রতারক মোঃ এহতেশামুল হক@ এ্যাডভোকেট নোমান ও তার তার শ্যালক জাহিদ হাসান ভূইয়াকে গ্রেফতার করে র্যাব।
উক্ত বিষয়ে গ্রেফতারকৃত আসামীদ্বয়ের বিরুদ্ধে কুমিল্লা জেলার কোতয়ালী মডেল থানায় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ প্রক্রিয়াধীন।
র্যাব-১১, সিপিসি-২ এর কোম্পানী অধিনায়ক মেজর মোহাম্মদ সাকিব হোসেন অভিযানের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
২৪ দিন আগে শনিবার, এপ্রিল ১৯, ২০২৫