ফল চাষ শিখতে কৃষি মন্ত্রণালয়ের একটি প্রকল্পের আওতায় ১৯৮ কর্মকর্তার বিদেশ ভ্রমণের আবদারে বিস্ময় সৃষ্টি হয়েছে পর্যবেক্ষক মহলে। বিদেশ ভ্রমণের এত বড় বহর থাকলেও দেশে প্রশিক্ষণ নেবেন মাত্র ১৭ জন। সূত্র জানায়, ১৯৮ কর্মকর্তার মধ্যে ইতিমধ্যে ৭৩ জন বিদেশ ভ্রমণে গেছেন। বাকি ১৭৫ জন সরকারের ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার কারণে যেতে পারছেন না।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের এ প্রকল্পের নাম ‘বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের
প্রকল্পের নথি ঘেঁটে দেখা যায়, তিন শ্রেণিতে বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ রাখা হয়েছে প্রকল্পে। এর মধ্যে সেমিনারে অংশ নিতে বিদেশ যাবেন আট কর্মকর্তা। এতে ব্যয় ধরা হয়েছিল দুই কোটি ৬৯ লাখ ৫৯ হাজার টাকা। ইতিমধ্যে তিনজন বিদেশে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। এ কারণে তৃতীয় সংশোধনী প্রস্তাবে এ খাতে বিদেশ ভ্রমণের জন্য পাঁচজনকে রাখা হয়েছে। এই পাঁচজনের বিদেশ যেতে ব্যয় হবে এক কোটি ৪৯ লাখ ৫৯ হাজার টাকা।
শিক্ষা সফরে বিদেশ যাবে কর্মকর্তাদের ১৫টি ব্যাচ। প্রতি ব্যাচে ১২ জন করে মোট ১৮০ জন কর্মকর্তা শিক্ষা সফরে যাবেন। এতে ব্যয় ধরা হয়েছিল ছয় কোটি ৯০ লাখ ৩০ হাজার টাকা। ইতিমধ্যে পাঁচ ব্যাচ কর্মকর্তা বিদেশে শিক্ষা সফরে গিয়েছেন তাই তৃতীয় সংশোধনী প্রস্তাবে ১০ ব্যাচ প্রশিক্ষণের জন্য রাখা হয়েছে। তাদের বিদেশে শিক্ষা সফরের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে চার কোটি ১১ লাখ ৭৩ হাজার টাকা।
এ ছাড়া নারিকেল হাইব্রিডাইজেশন শিখতে ১০ জনের বিদেশ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। এতে ব্যয় ধরা হয়েছিল ৫০ লাখ টাকা। তারা বিদেশে প্রশিক্ষণে যাওয়ায় তৃতীয় সংশোধনীতে এটি বাদ দেওয়া হয়েছে।
অর্থাৎ তিন ক্যাটাগরিতে বিদেশ যাওয়ার জন্য ১৯৮ জনকে রাখা হয়েছে। তৃতীয় সংশোধনীতে বাদ গেছে ৭৩ জন। অর্থাৎ এখনও ১২৫ জন কর্মকর্তা বিদেশ প্রশিক্ষণে যেতে চান। ১৯৮ কর্মকর্তার বিদেশ প্রশিক্ষণের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছিল ১০ কোটি ৯ লাখ ৮৯ হাজার টাকা। তৃতীয় সংশোধনী প্রস্তাবে তা কমে পাঁচ কোটি ৬১ লাখ ৩২ হাজার টাকায় দাঁড়াচ্ছে। এতে চার কোটি ৪৮ লাখ ৫৭ হাজার টাকা কমছে এ খাতে। বিদেশ ভ্রমণে এত কর্মকর্তার আগ্রহ দেখালেও প্রকল্পে দেশে প্রশিক্ষণ নেওয়ার আগ্রহ কম দেখা গেছে। প্রকল্পের আওতায় মাত্র ১৭ জনকে দেশে প্রশিক্ষণের জন্য রাখা হয়েছে। এখন পর্যন্ত দেশে কেউ প্রশিক্ষণ নেয়নি।
এ বিষয়ে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, এত মানুষ বিদেশে প্রশিক্ষণের জন্য যাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। এক-দুইজন গেলেই তো একটি পুরো দেশ ভ্রমণ করে আসতে পারে। ওইসব দেশ থেকে এক থেকে তিন মাসের জন্য কয়েকজন এক্সপার্ট নিয়ে আসত। তারা আমাদের দেশে এসে প্রশিক্ষণ দিত। এতে খরচ অনেক কমে যেত। দেশের টাকা অপচয় হতো না। তারা যে বিদেশে গেছে, দেশে এসে কতটুকু অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, বিদেশে গিয়ে ঘুরে চলে আসে তাদের অভিজ্ঞতা কোনো কাজেই লাগে না।
তিনি বলেন, কৃষি মন্ত্রণালয়ের এ প্রকল্প কতটুকু কাজে লেগেছে দেশের ফল উৎপাদন কতটুকু বেড়েছে এগুলো দেখা দরকার। একটা প্রকল্প নিলে তার আউটপুট জানার প্রয়োজন আছে। খালি প্রকল্প নিলেই তো হয় না, লক্ষ্য বাস্তবায়ন হচ্ছে কি না সেটাও দেখতে হয়। সঠিক সময়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন না করার কারণে প্রকল্পের ব্যয় বাড়ে, অর্থ অপচয় হয়- এটা বন্ধ করতে হবে।
প্রকল্প পরিচালক ড. মোহাম্মদ মেহেদি মাসুদ বলেন, এ প্রকল্প গ্রহণ করার পর থেকে দেশে ফল উৎপাদন ২৫ লাখ মেট্রিকটন বেড়েছে। সরকার মনে করছে, এটি চলমান রাখলে আরও ফল উৎপাদনের সক্ষমতা বাড়বে। তাই এ প্রকল্পের কার্যক্রম বৃদ্ধি করা হচ্ছে। সে জন্য প্রকল্পের সময় ও ব্যয় বেড়েছে। প্রকল্পের আওতায় ইতিমধ্যে ৭৩ জন বিদেশ প্রশিক্ষণে গেছেন। তারা দেশে এসে প্রকল্পের কাজে অবদান রাখছেন। এ প্রকল্পের তৃতীয় সংশোধনী প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে। সামনের একনেকে এটি পাস হতে পারে। একনেকের আগে প্রি-মিটিং হয়েছে। সেখানে আরও কর্মকর্তার বিদেশ প্রশিক্ষণে অনেকে আপত্তি জানিয়েছেন।
প্রকল্পের নথি ঘেঁটে আরও দেখা যায়, বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন শীর্ষক প্রকল্পটি কৃষি মন্ত্রণালয়ের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর (ডিএই) বাস্তবায়ন করবে। এটি ২০১৫ সাল থেকে ২০২০ সাল মেয়াদে বাস্তবায়নের জন্য একনেক সভায় অনুমোদন দেওয়া হয়। তখন ব্যয় ধরা হয়েছিল ১৯৫ কোটি টাকা। তবে নির্দিষ্ট সময়ে শেষ হয়নি এ প্রকল্প। এরপর দুই দফায় বাড়িয়ে প্রকল্পের মেয়াদ দাঁড়াচ্ছে ১০ বছর। এটির মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে এবং ব্যয় ধরা হয়েছে ৬৭১ কোটি ৬০ লাখ টাকা। অর্থাৎ মোট ব্যয় বেড়েছে ৪৭৬ কোটি ৫৯ লাখ টাকা বা তিনগুণ।
প্রকল্পের উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে, দেশের তিনটি পাহাড়ি জেলাসহ অন্যান্য জেলার অসমতল, পাহাড়ি জমি এবং উপকূলীয় অন্যান্য অঞ্চলের অব্যবহৃত জমি ও বসতবাড়ির চারপাশের জমি আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদের আওতায় এনে উদ্যান ফসলের উৎপাদন শতকরা ২০ ভাগ বৃদ্ধির পাশাপাশি সমতল ভূমিতে অন্যান্য মাঠ ফসলের উৎপাদনের সুযোগ অক্ষুণ্ন রাখা।
দেশীয়, সম্ভাবনাময় বিদেশি এবং রফতানিযোগ্য ফলের উৎপাদন ক্লাস্টার/ক্লাবভিত্তিক বৃদ্ধির মাধ্যমে আমদানিনির্ভরতা কমানোর পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করা এবং উৎপাদিত, ফলের সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়নের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণ সেবা সম্প্রসারণ করা।
উৎপাদক, সম্প্রসারণ কর্মী ও সংশ্লিষ্ট অন্য সব সুবিধাভোগীর প্রযুক্তিগত দক্ষতা বৃদ্ধি, মানসম্মত ফল উৎপাদন প্রযুক্তি, ফলের সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনা, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণ ইত্যাদি বিষয়ে যথাযথ প্রশিক্ষণ দেওয়া, প্রদর্শনী ও অন্যান্য টেকসই পদ্ধতির মাধ্যমে উদ্যান ফসলের আধুনিক প্রযুক্তিগুলো চাষি পর্যায়ে সম্প্রসারণ করা এবং নারীদের ক্ষমতায়ন বৃদ্ধি ও উদ্যান বিষয়ে কাজের সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচন।
প্রকল্পের প্রধান প্রধান কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে মোট চার লাখ ৭৬ হাজার ১৬০ জন কৃষক, উদ্যান বিষয়ক কৃষক, মহিলা উদ্যোক্তা, এসএএইচও/এসএএও, নার্সারিম্যান, মালি ও স্প্রেম্যানের প্রশিক্ষণ। বাণিজ্যিক মিশ্র ফল বাগান-১৩ হাজার ৫০০টি, বাণিজ্যিক ফল বাগান ৯ হাজারটি, বসতবাড়ি বাগান ২৩ হাজারটি, ড্রাগন বাগান দুই হাজার ৫০০টি, এমডি-২ আনারস দুই হাজার ৫০০টি প্রদর্শনী এবং বিদ্যমান ও নতুন প্রস্তাবিত হর্টিকালচার সেন্টারের ভূমি উন্নয়ন ১৬ লাখ ঘনমিটার ও ৫২ একর ভূমি ক্রয়। বিদ্যমান ভবনের ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণ ৫টি, অফিস ভবন কাম ট্রেনিং রুম ২৬টি, ৩৫ হাজার ৭০০টি আরএম সীমানা প্রাচীর, ৩০টি লেবার শেড, ৪৫টি গার্ড শেড, ৬০টি নার্সারি শেড, ১৫টি গ্রাফটিং হাউস নির্মাণ এবং মেহেরপুর জেলায় ঐতিহাসিক মুজিবনগর আম্রকাননের পরিচর্যা।
প্রকল্পের আওতায় ৮টি বিভাগের ৫১টি জেলার ৪০৩টি উপজেলা ও ৭৪টি হর্টিকালচার সেন্টার স্থাপন করা হবে।
২৬ দিন আগে রবিবার, এপ্রিল ২০, ২০২৫