বাংলাদেশ ও ভারত। পাশাপাশি দু’টি শব্দের অবস্থান ও উচ্চারণ যেমন মধুর ও ভালোবাসার ঠিক, তেমনই ভৌগলিকভাবে দু’টি দেশের মানুষের সম্পর্ক ও অবস্থানও হৃদয়ের। মাছে ভাতে বাঙালি। আর বাঙালির অতিথিপরায়ণের কথা নাই বা বললাম।
বাংলাদেশিরা বিশ্বের সবচেয়ে বেশি অতিথিপরায়ণ জাতি। অতিথির মন রক্ষা করতে বাঙালিরা সবকিছুই করে। আর ভারতীয়রাও বা কম কিসের। তারাও কী কম অতিথিপরায়ণ ? ভারতীয়দের কাছে অতিথি
গত ১২ অক্টোবর ভারত সরকারের ব্যবস্থায় বাংলাদেশ ইয়ুথ ডেলিগশেনের সদস্য হয়ে ১০০ তরুণ-তরুণী গিয়েছে ভারতে। সফরের দ্বিতীয় দিন আগ্রার তাজমহল দেখে তরুণ-তরুণীরা যখন হোটেলে ফিরছিল তখন ঘোষণা এলো, ১৪ অক্টোবর বিকালে বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশের রাষ্ট্রপতি ভবনে যাচ্ছি আমরা।
ঘোষণা শুনতেই সবাই খুশি। ভারতের রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করবো এটি ভাবতেই অনেক আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠলো। ১৪ অক্টোবর দুপুরের খাবার খেয়েই সবাই চলে গেলো সাজগোজ করার জন্য। নারীরা দেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে তুলে ধরতে পরলেন শাড়ি।
একেকজন একেক রকমের শাড়ি, কেউ জামদানি তো কেউ আবার সিল্ক। কেউ কাতান তো কেউ মনিপুরি আবার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মেয়েরা পড়েছিলেন থামিসহ তাদের নিজস্ব পোশাক। অন্যদিকে পুরুষরাই কম কিসের। স্যুট, প্যান্ট ও টাই পড়ে সবাই রেডি।
এবার হোটেল লবিতে অপেক্ষা গাড়ির জন্য। বাস এলো হোটেলের সামনে। হোটেল থেকে পুলিশ প্রটোকলে বাংলাদেশি শত তরুণ-তরুণীকে বহন করা বাস চলতে লাগলো ‘রাষ্ট্রপতি ভবন’ এর উদ্দেশ্যে।
৩৩০ একর জায়গার উপর নির্মিত রাষ্ট্রপতি ভবনে ঢুকতেই ডেলিগেশন টিমের সব সদস্যদের চোখ আটকে গেলো। অপূর্ব সুন্দর, পরিপাটি ও স্থাপত্যশৈলিতে মুগ্ধ সবাই। ৩৩০ একরের মধ্যে ৭৫ একরের বেশি জায়গাজুড়ে আছে বাগান। আছে জলাধার, প্রজাপতি কর্নার, বরইগাছের উদ্যান, আমবাগান, ময়ূর পয়েন্ট, কমলালেবুর বাগান ও বন।
আছে নানা জাতের হাজারো গাছগাছালি ও পশুপাখি। যেহেতু রাষ্ট্রপতি ভবনে মোবাইল ফোন নিয়ে ঢুকতে দেবে না, তাই ডেলিগেটসরা যে যেভাবে পারছেন গাড়ি থেকেই ছবি বা ভিডিও করে ফোনটি ব্যাগে রেখে দিল। গাড়ি থেকে নেমে বাংলাদেশ ইয়ুথ ডেলিগেশনের (বিওয়াইডি) সিরিয়াল অনুযায়ী সবাই সারিবদ্ধ দাঁড়িয়ে গেলাম।
সিকিউরিটি গার্ডের সদস্যরা এসে জানালেন, ফোন বা ব্যাগ নিয়ে রাষ্ট্রপতি ভবনে যাওয়া যাবে না। যদিও পূর্ব নির্দেশনা অনুয়ায়ী আমরা সবাই ফোন আর ব্যাগ গাড়িতেই রেখে এসেছিলাম। তালিকা দেখে নাম যাচাই করে একে একে সবাইকে প্রবেশ করানো হলো রাষ্ট্রপতি ভবনে।
রাষ্ট্রপতি ভবনে ঢুকে ১-৫০ পর্যন্ত সিরিয়ালের সবাই বসলেন হাতের বাম পাশে আর ৫১-১০০ পর্যন্ত সিরিয়ালের সবাই বসলেন ডানদিকে। রাষ্ট্রপতি ভবনে ঢুকে চোখে পড়লো ভবনের সৌন্দর্য। তথ্য অনুযায়ী, ইন্ডিয়া গেটের মুখোমুখি রাজপথের পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত রাষ্ট্রপতি ভবনে আছে মুঘল গার্ডেনসহ ৯টি টেনিস কোর্ট।
আরও আছে একটি পোলো মাঠ, একটি ১৪ গর্তের গল্ফ কোর্স ও একটি ক্রিকেট মাঠ আছে। চারতলা অট্টালিকাটিতে আছে ৩৪০টি ঘর ও এর কার্পেট এরিয়া ২ লাখ বর্গফুট। ভবন নির্মাণে কোনো ইস্পাত ব্যবহৃত হয়নি। তথ্যমতে, ২৯ হাজার শ্রমিক ১৭ বছর ধরে এই ভবনটি তৈরি করেন।
ভারতের প্রথম ভাইসরয় লর্ড ইরউইনের জন্য এই ভবন তৈরির চিন্তা আসে ব্রিটিশ প্রকৌশলী স্যার এডউইন লুটিয়েনছের মাথায়। ১৯২৯ সালে এই ভাইসরয় এই ভবনে ওঠেন। ভারতের প্রথম গভর্নর জেনারেল সি রাজাগোপালাচারি প্রথম এই বাসভবনে ছিলেন।
তখন এর নাম ছিল গভর্নমেন্ট হাউস। যখন ভবনটি তৈরি হয়, তখন এর নাম ছিল ভাইসরয়’স হাউস। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ভারত স্বাধীন হওয়ার পর এই ভবনের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় গভর্নমেন্ট হাউস। পরে রাষ্ট্রপতি ড. রাজেন্দ্র প্রসাদের সময় এর নাম হয় রাষ্ট্রপতি ভবন।
রাষ্ট্রপতি ভবনের দরবার কক্ষেই আয়োজন করা হয়েছিল বাংলাদেশ ইয়ুথ ডেলিগেশনের সদস্যদের জন্য আয়োজিত অনুষ্ঠান। দরবার কক্ষে যেখানে রাষ্ট্রপতির আসন অবস্থিত ঠিক তার পেছনেই ছিল একটি প্রাচীন বুদ্ধমূর্তি।
যার নির্মাণকাল চতুর্দশ শতাব্দী। বুদ্ধমূর্তিটাকে প্রথম দেখাতেই মন জুড়িয়ে যাবে। বুদ্ধমূর্তিটি দেখেই আমি পাশের একজনকে বললাম এটিই হচ্ছে সেকুলার ভারতের নিদর্শন।
দরবার কক্ষেই অপেক্ষা করছিলাম সেই মহিয়সী নারীর জন্য। যিনি স্কুল শিক্ষক থেকে বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশের রাষ্ট্রপ্রধান হয়েছেন। ভারতসহ বিশ্বের সব নারীর অনুপ্রেরণার মানুষ শ্রীমতি দ্রৌপদি মুর্মু জি।
এর মধ্যে অবশ্য রাষ্ট্রপতি ভবনের কর্মকর্তারা আমাদের পুরো ডেলিগেশন টিমকে দু’ভাগে বিভক্ত করে ছবি তোলার জন্য প্রস্তুতি সেরে ফেলেছেন। আমরা ডামি পোজ দিয়েও চলে এসেছি।
হঠাৎ করে দেখলাম দরবার কক্ষে নিরবতা বিরাজ করছে। ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছেন ভারতের মহামান্য রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু। সামনে সেনাবাহিনী ও বিমান বাহিনীর দুই সুদর্শন অফিসার, পেছনে আছে সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তারা। রাষ্ট্রপতির জন্য নির্ধারিত চেয়ারের সামনে এসে দু’হাত জোড় করে নমস্কার জানালেন সবাইকে।
এরপর বেজে উঠলো ভারতের জাতীয় সংগীত। শেষে আসন গ্রহণ করলেন মহামান্য রাষ্ট্রপতি। এরপর স্বাগত বক্তব্য রাখেন ভারতের যুব ও ত্রীড়া মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ও ডেলিগেশনের পক্ষে বক্তব্য রাখলেন অমরিতা বর্মণ।
এরপর বক্তব্য দিতে আসেন রাষ্ট্রপতি। ভারতের রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু বলেন, ‘বাংলাদেশ প্রত্যেক ভারতীয়ের হৃদয়ে ও মনে একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বন্ধু ও অংশীদার হতে পেরে ভারত গর্বিত।’
‘ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে উন্নয়ন যাত্রা ভাগাভাগি করে চলেছে। এই চেতনা রক্ষা করা আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, যা আমাদের দুই দেশ ও আমাদের জনগণের মধ্যে গভীর বন্ধুত্বকে অনুপ্রাণিত করে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা, এর উত্থান ও সমৃদ্ধি বিশ্ব সম্প্রদায়ের জন্য একটি অনুপ্রেরণাদায়ক গল্প। বাংলাদেশের তরুণদের একটি অতীত আছে, যা গৌরবে পূর্ণ ও একটি ভবিষ্যত যা প্রতিশ্রুতিতে পূর্ণ।’
‘বাংলাদেশ প্রত্যেক ভারতীয়ের হৃদয়ে ও মনে একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। আমাদের দু’ দেশের মধ্যে গভীর সভ্যতাগত সম্পর্ক আছে। আমরা শিল্প, সঙ্গীত ও সাহিত্যসহ আমাদের মধ্যে অনেক কিছু শেয়ার করি। উভয় দেশ এই সম্পর্কের প্রতি যে বিশেষ গুরুত্ব দেয় তা দেখায়।’
রাষ্ট্রপতি ইয়ুথ ডেলিগেশন টিমের সদস্যদের ভারত ও বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে শান্তি, সমৃদ্ধি ও বন্ধুত্বের সোনালি যুগের সূচনার আহ্বান জানান তিনি।
বক্তব্য শেষে পুনরায় ভারতীয় জাতীয় সংগীত বেজে উঠলো। জাতীয় সংগীত শেষে দরবার কক্ষ ত্যাগ করলেন রাষ্ট্রপতি। এরপর আমরা দুই গ্রুপে বিভক্ত হয়ে ছবি তোলার জন্য নির্ধারিত কক্ষে প্রবেশ করলাম। প্রথমে ১-৫০ পর্যন্ত সিরিয়ালের সদস্যরা এবং পরে ৫১-১০০ পর্যন্ত সিরিয়ালের সদস্যরা রাষ্ট্রপতির সঙ্গে ছবি তুললেন।
ছবি তোলা শেষে রাষ্ট্রপতি ইয়ুথ ডেলিগেশনের সদস্যদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করলেন। তিনি বাংলায় সবাইকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেমন আছেন সবাই?’ ইয়ুথ ডেলিগেশনের সদস্যরা রাষ্ট্রপতির মুখে বাংলা শুনে খুশি হয়ে বললেন আমরা সবাই ভালো আছি।
এরপর রাষ্ট্রপতি সফর কি রকম হচ্ছে, খাবার কেমন লাগছে, পরিবেশ কেমনসহ নানা বিষয় জিজ্ঞেস করলেন। বাংলাদেশের তরুণ-তরুণীরা কেউ ইংরেজিতে, কেউ বা হিন্দিতে সুন্দরভাবে উত্তর দিলেন। এর মধ্যে একজন বললেন, ‘ম্যাডাম খানা সেইম, লেকিন টেস্ট ডিফারেন্ট হে’।
পরে আরো অনেক কথা বললেন রাষ্ট্রপতি। এছাড়া ইয়ুথ টিমে নারীদের সংখ্যা বেশি শুনেও তিনি খুশি হন। ইয়ুথ ডেলিগেশনের সদস্যরা রাষ্ট্রপতিকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানান। পরে ইয়ুথ ডেলিগেশনের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রপতিকে একটি শাড়ি উপহার দেওয়া হয়।
কুশল বিনিময় শেষে সেখান থেকে চলে যান রাষ্ট্রপতি। আর বাংলাদেশের তরুণ তরুণীরা চলে যান ব্যাঙ্কোয়েট হলে। যে কোনও দেশের রাজপ্রাসাদের মতোই ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবনের ব্যাঙ্কোয়েট হলটি বিশালাকার। এই ঘরের আলোর ব্যবস্থা অপূর্ব সুন্দর।
ঘরের দেওয়ালে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতিদের প্রতিকৃতি সাজানো আছে। তাতে আলোর কারসাজি দেখে মুগ্ধ হতে হয়। এছাড়া সেগুলো অটোমেটিক আলো সেট করা আছে।
এই আলোর গতি ও ঔজ্জ্বল্য দেখে রাষ্ট্রপতি ভবনের কর্মীরা বোঝেন যে সেই ঘর পরিষ্কার করার সময় এসে গেছে। ব্যাঙ্কোয়েট হলে রাষ্ট্রপতির সৌজন্যে বাংলাদেশের তরুণ-তরুণীদের সন্ধ্যার খাবারের ব্যবস্থা করা হলো।
২৫ দিন আগে শনিবার, এপ্রিল ১৯, ২০২৫