বাংলাদেশ রেলওয়ের সবচেয়ে পুরনো সেকশনগুলোর অন্যতম ষোলশহর-দোহাজারী ও ফতেয়াবাদ-নাজিরহাট সেকশন। রেলপথ মেরামতের সোয়া ২০০ কোটি টাকার প্রকল্পটি শেষ হয়েছে ২০১৮ সালে। তবে এ প্রকল্পের কাজ অনিয়মে ভরপুর ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। বাধ্য হয়ে রেলপথ দুটি নতুন করে সংস্কারে যেতে হচ্ছে রেলওয়েকে।
১৯৩১ সালে চট্টগ্রাম থেকে দোহাজারী পর্যন্ত রেল যোগাযোগ শুরু হয়। নির্মাণের পর ১৯৮০-৮৬ সালের মধ্যে দোহাজারী
রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, দুই দফায় বাড়ানো সময়ে প্রকল্প শেষ হলেও কাজের গুণগত মান ছিল নিম্ন। যার কারণে বড় প্রকল্পের মাধ্যমে এ রুটের সংস্কার করা হলেও ট্রেনের গতি আশানুরূপ বাড়ানো যায়নি। আগে এ দুটি রেলপথ দিয়ে ট্রেন সর্বোচ্চ ২০-২৫ কিলোমিটার গতিতে চললেও সংস্কারের পর গতি বেড়েছে ১০-১৫ কিলোমিটার। কিছু কিছু অংশে সংস্কারের পূর্বের গতিতেই ট্রেন চলছে। এ কারণে সাম্প্রতিক সময়ে অন্তত ২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নতুন করে সংস্কারকাজ শুরু করতে হচ্ছে ষোলশহর-দোহাজারী সেকশনটিতে। দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত নতুন রেললাইন স্থাপন কাজ শেষ পর্যায়ে চলে আসায় তড়িঘড়ি করে ৪৫ কিলোমিটার রেলপথটিতে আবারো সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) প্রকল্পসংক্রান্ত মূল্যায়ন প্রতিবেদনেও এ চিত্র উঠে এসেছে।
প্রকল্পটি বর্ধিত সময়ে শেষ হওয়ার পর ২০১৯ সালের ১৭ ও ১৮ জুন পরিদর্শনে আইএমইডির মাঠ পর্যায়ের পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রকল্পের অধীনে সর্বমোট নয়জন পরিচালক পরিবর্তন হয়েছে। ব্যালাস্ট বা রেলপথের গুরুত্বপূর্ণ পাথর ছাড়া অন্যান্য উপকরণ অর্থাৎ রেলপাত, অ্যান্টিভেন্ডাল কংক্রিট স্লিপার, কাঠের স্লিপার, ওয়েলডিং উপকরণ, রাবার প্যাড, রেল ক্লিপ বসানো হয়েছে, কিন্তু ষোলশহর-দোহাজারী রেলপথে ৫৫ হাজার ঘনমিটার ব্যালাস্ট দেয়ার কথা থাকলেও দেয়া হয়েছে মাত্র ৭ হাজার ঘনমিটার। অন্যদিকে ফতেয়াবাদ-নাজিরহাট সেকশনে ২৭ হাজার ঘনমিটারের স্থলে পাথর দেয়া হয়েছে ১৩ হাজার ঘনমিটার। পরিদর্শনকালে পুনর্বাসিত ট্র্যাক সেকশনে পাথরের পরিমাণ অত্যন্ত কম এবং ট্র্যাক সেকশনে পাথর কম থাকায় রেললাইন অনেক স্থানে আঁকাবাঁকা ও স্লিপার ফেটে যেতে দেখে আইএমইডি দল। সার্বিকভাবে পুনর্বাসিত ট্র্যাক সেকশনে কাজের মান সন্তোষজনক পাওয়া যায়নি বলে মন্তব্য করেছেন পরিকল্পনা বিভাগের কর্মকর্তারা।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, পাথর না থাকার কারণে ট্রেন চলাচলের কারণে প্রকল্প বাস্তবায়নের অল্প সময়ের মধ্যেই রেলপথ আঁকাবাঁকা হয়ে যাওয়ার পাশাপাশি স্লিপারগুলো ফেটে গেছে। সার্বিকভাবে পুনর্বাসিত ট্র্যাক সেকশনের কাজের মান সন্তোষজনক পাওয়া যায়নি। তাছাড়া ষোলশহর-দোহাজারী সেকশনের ৬০টি ও ফতেয়াবাদ-নাজিরহাট সেকশনের ৪৭টি সেতু নির্মাণ অথবা পুনঃনির্মাণের কথা ছিল। এর মধ্যে ষোলশহর-দোহাজারী সেকশনের ৬০টি সেতুর জন্য নুনা ট্রেডার্স-আরপি কন্সট্রাকশনের (জেভি) থাকলেও ২০১৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত ৩১টি সেতুর কাজ শেষ করেনি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি। এ কারণে ১৩ কোটি ৯৯ লাখ ৯৭ হাজার টাকার চুক্তিবদ্ধ থাকা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করে পরবর্তী সময়ে ৩২টি সেতুর জন্য ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে মেসার্স এসএসইসিএল-এসই (জেভি)-এর সঙ্গে ৪২ কোটি ৭০ লাখ টাকায় চুক্তি করা হয়। অন্যদিকে ফতেয়াবাদ-নাজিরহাট সেকশনে ৪৭টি সেতু পুনঃনির্মাণ অথবা আংশিক মেরামতের জন্য ২০১১ সালে ৪ কোটি ৮০ লাখ ৮৭ হাজার টাকায় দেশীয় মো. ইউনুছ অ্যান্ড ব্রাদার্সের সঙ্গে চুক্তি হলেও শতভাগ কাজ সম্পন্ন হয়নি। প্রকল্পের আওতায় সেতু মেরামত কিংবা পুনঃনির্মাণ করা হলেও সেতুর একপাশ অথবা উভয় পাশ ভরাট হয়ে সেতুগুলো অকার্যকর হয়ে গেছে বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। দুই সেকশনের যেসব সেতু প্রকল্পের বাইরে রাখা হয়েছিল সেগুলো অত্যন্ত নাজুক হয়ে পড়েছে বলে জানিয়েছে আইএমইডি। প্রকল্পটির স্টেশন ভবন নির্মাণ কিংবা পুনর্র্নিমাণের ক্ষেত্রে গাফিলতি ও চুক্তি ভঙ্গের প্রমাণ পেয়েছে সংস্থাটি। যার কারণে প্রকল্প শেষ হওয়ার চার বছরের মাথায় ফের নতুন প্রকল্প হাতে নিতে যাচ্ছে রেলওয়ে। ঢাকা-কক্সবাজার রেলপথ চালু হওয়ার আগেই অন্তত দোহাজারী পর্যন্ত রেলপথ সংস্কার করতে তোড়জোড় শুরু হয়েছে রেলওয়ের।
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রকৌশল বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্পটির জন্য ২৩২ কোটি ৩৬ লাখ ৬১ হাজার টাকা অনুমোদিত হলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো ঠিকমতো কাজ না করায় ব্যয় হয়েছে ১৯৭ কোটি ৪৯ লাখ ৮১ হাজার। কাজ পূর্ণাঙ্গ না হওয়ায় নতুন করে ফতেয়াবাদ-নাজিরহাট ও ষোলশহর-দোহাজারী সেকশনের রেলপথ সংস্কার করতে হবে। এরই মধ্যে এ-সংক্রান্ত একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করতে না পারায় এ প্রকল্পের খরচ আরো বাড়বে। শুধু ষোলশহর-দোহাজারী সেকশনের জন্যই বাড়তি ব্যয় হবে ২৫-৩০ কোটি টাকা। তাছাড়া প্রকল্পের বাইরে থাকা সেতু ও অবকাঠামো সংস্কার ছাড়াও প্রকল্পের মাধ্যমে কাজ করা অংশ নষ্ট হওয়ায় এ রেলপথ পুরোপুরি সংস্কারে শত কোটি টাকা ব্যয় হতে পারে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের নির্বাহী প্রকৌশলী (পিএন্ডডি) ও ট্র্যাক সাপ্লাই অফিসার (টিএসও) আবু রাফি ইমতিয়াজ হোসাইন বলেন, ‘কয়েকটি প্যাকেজে ষোলশহর-দোহাজারী সেকশনের সংস্কারকাজ প্রক্রিয়াধীন। বেশ কয়েকটি প্যাকেজের দরপত্র আহ্বান ছাড়াও দুটি প্যাকেজের ঠিকাদার নিয়োগ হয়ে গেছে। শিগগিরই এ রেলপথের সংস্কারকাজ শুরু হবে।
সূত্র: বণিক বার্তা।
৯ দিন আগে রবিবার, এপ্রিল ২০, ২০২৫