আক্রমনাত্মক কথার লড়াইয়ে জমে উঠেছে কুমিল্লা জেলার প্রাণকেন্দ্র সদরের রাজনীতি। সদর সাংসদ হাজী আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার ও কুসিকের সাবেক মেয়র বিএনপির প্রভাবশালী নেতা মনিরুল হক সাক্কু এখন ব্যস্ত একে অপরকে কথা দিয়ে ঘায়েল করতে।
রাজনৈতিক দিক থেকে তারা একে অপরের প্রতিপক্ষ হলেও বিগত ১৩/১৪ বছরে তাদের দুজনের মধ্যে ছিল মধুর ও আন্তরিক সম্পর্ক । গত সিটি নির্বাচনের পর থেকে তাদের দুজনের
মধুর সম্পর্কের পথ দুদিকে বেকে যায়। আনুগত্য, ভালবাসা রূপ নেয় চরম বিষাদে। সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে শেষ মুহূর্তে নানা নাটকীয়তার জন্ম নিয়ে আরফানুল হক রিফাত নগর পিতা নির্বাচিত হন। আর এরপরই সাক্কুর সাথে এমপি বাহারের সর্ম্পক চূড়ান্তভাবে ভাঙ্গন হয়। কুসিক নির্বাচনের পরপরই মেয়র সাক্কু ঘোষণা দেন-আগামী সাংসদ নির্বাচনে সদর আসন থেকে তিনি প্রার্থী হবেন। বিএনপি মনোনয়ন না দিলেও তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হবেন- এমন ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন মনিরুল হক সাক্কু। সেই লক্ষ্যে বিভিন্ন এলাকায় জনসংযোগও অব্যাহত রেখেছেন সাবেক কুসিক মেয়র। কুমিল্লা সদরে আ’লীগের মনোনয়ন হাজী বাহার পাচ্ছেন, তা এক প্রকার নিশ্চিতই বলা যায়। এদিকে বিএনপি এই সরকারের অধীনে নির্বাচনে না আসলেও সাক্কু স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন। ফলে হাজী বাহারের প্রতিদ্বন্দ্বী মনিরুল হক সাক্কু হতে যাচ্ছেন তাও প্রায় নিশ্চিত। এই আসনের নির্বাচন ব্যাপক প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে বলে অনেকে মনে করছেন । তাই সামনে এমপি বাহার আর সাক্কুর মধ্যে সম্পর্ক যে আরো খারাপ হবে তা বলাই যায়। যার প্রমাণ গত কয়েক মাসে দৃশ্যমান।মহানগরের বিভিন্ন ওয়ার্ডে আ’লীগের সম্মেলন চলছে । সেখানে মধ্যমনি হয়ে উপস্থিত থাকছেন এমপি বাহার। প্রায় সম্মেলনেই বক্তব্য দিতে গিয়ে প্রকাশ্যে সাবেক মেয়র সাক্কুকে চোর, ডাকাত, দুর্ণীতিবাজ বলে একহাত নিচ্ছেন এমপি বাহার ।সাক্কুও থেমে নেই, প্রতিনিয়ত জবাব দিয়ে যাচ্ছেন ।
আ’লীগের ওয়ার্ড সভাগুলোতে এমপি বাহার বলেন- কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনকে সাক্কু ধ্বংস করে দিয়ে গেছে। সাক্কু ডাকাত ছিল, সে কুমিল্লার মানুষের টাকা লুট করে কানাডায় ব্যবসা করছে। "সাক্কু তিন মেয়াদে কুমিল্লার মেয়র ছিলেন। কিন্তু কোনো উন্নয়ন হয়নি। সাক্কু মেয়র ছিলেন, আকবর হোসেন মন্ত্রী ছিলেন। তারপরও কোনো অগ্রগতি হয়নি। আমি যখন এমপি হয়েছি, টাকা এনেছি, সাক্কু সাহেব তা লুট করেছেন। কুমিল্লার মানুষের রক্ত বিক্রি করে ৭৮টি ফ্ল্যাট বানিয়েছেন। এই ৭৮টি ফ্ল্যাট কোথা থেকে এল? রূপায়ণ টাওয়ার করতে ৭৫ লাখ টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে। প্ল্যানেট এসআর এর প্ল্যান পাশ করতে ৭৫ লাখ টাকা নিয়েছে। সারা শহরে টাকা দিয়ে অপরিকল্পিতভাবে ভবনের প্ল্যান পাশ করেছেন। সাক্কু সহজ-সরল মানুষের মতো কথা বলে। সাক্কু তার নিজের পকেটে ঢুকিয়েছে সব টাকা। আমি সবই জানছি পরে। সাক্কু নিয়ম-নীতি না মেনে কুমিল্লা শহরকে নষ্ট করেছে।কুমিল্লা সিটিকে ওভারলোড করে দিয়েছে সাক্কু। আজ যানজটের জন্য শহরে হাঁটা যায় না। ভবনের পর ভবনের প্ল্যান পাস হয়েছে নিয়ম না মেনেই। আমি রিফাতকে তিল তিল করে কুমিল্লার মানুষের জন্য গড়ে তুলেছি। রিফাতের ১ বছর পার হয়েছে মেয়র হিসেবে। আপনারা তার ঘুষের কোনো প্রমাণ পেয়েছেন? পেলে আমাকে বলুন। আমি তখন আর এখানে (মঞ্চে) থাকব না। আমি চলে যাব জনগণের কাতারে। তখন আর রিফাতকে চেয়ারে থাকতে দেব না। আমি বারবার রিফাতের মনোনয়নের জন্য দলের কাছে গিয়েছি, হয়নি। যখন রিফাত মনোনয়ন পেয়েছেন, সাক্কু ভোটে হেরেছেন। আরো আগে রিফাতের মনোনয়ন পাওয়া গেলে কুমিল্লার মানুষের টাকা লুট করতে পারতেন না সাক্কু। তবে সাক্কুর বিরুদ্ধে অচিরেই আইনত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অপেক্ষা করেন।
এদিকে এমপি বাহারের বিভিন্ন অভিযোগের জবাবে সাবেক মেয়র মনিরুল হক সাক্কু জানান, ‘উনার জিদ হলো- আমি কেন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন করলাম। যদি রিফাত মনোনয়ন না পেত, তাহলে আমি উনার কাছে ভালো থাকতাম। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও আমি বিএনপির মনোনয়ন চাইব। দল মনোনয়ন না দিলে স্বতন্ত্র থেকে নির্বাচন করব। ১২ বছর আমি ভালো ছিলাম। এখন খারাপ হয়ে গেছি। উনার সাথে এক যুগ সংসার করেছি, এখন আমি লুটেরা হয়ে গেলাম। কাজের স্বার্থে উনার সঙ্গে আমার আন্তরিক সম্পর্ক ছিল। এখন আমি খারাপ। উনি এমপি, সরকার উনার। দেশে আইন আছে, প্রশাসন আছে। বিচার করবে সরকার, প্রশাসন। সিটি করপোরেশনে সব ফাইল আছে। উনাকে বলেন, আমার বিরুদ্ধে মামলা দিতে। আমি যদি চুরি করে থাকি? মামলা দেন। আপনি যদি বাঘের বাচ্চা হয়ে থাকেন আমার অনিয়ম বের করে মামলা দেন। ইনকাম ট্যাক্স অফিস আছে। তারা তদন্ত করবে। আমি ফেস করব।নির্বাচনের তফশিল ঘোষণা হউক আমি সব বলব। এখন বলার সময় হয়নি। এক হাতে তালি বাজে না। আমি চোর, উনি কিছু না। আমি ডাকাত, উনি কিছু না। এমপি বাহার আমার বিরুদ্ধে পরিকল্পিতভাবে অপপ্রচার চালাচ্ছেন। যার কোনো ভিত্তি নেই।নগরীতে আমার নিজস্ব জমিতে একটি ডেভেলপার ভবন নির্মাণ করে। এতে শতাংশ হিসাবে আমি অনেক ফ্ল্যাট ভাগে পেয়েছি। আর নগরীতে কীভাবে ভবনের প্ল্যান পাশ হয়েছে, এমপি বাহার সবই জানেন। কেন এসব প্রপাগান্ডা, কুমিল্লার মানুষ সব বোঝে। সামনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ওই নির্বাচনে আমি প্রার্থী হব। এ কারণে তিনি আমার বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত বক্তব্য দিচ্ছেন। তিনি বলে যাচ্ছেন, তাই আমিও বলছি।
সব মিলিয়ে কুমিল্লা সদর রাজনীতিতে উত্তাপ ছড়িয়ে পড়েছে। সামনে কি শুধু কথার লড়াই চলবে, নাকি তা সংঘর্ষে রূপ নিবে, তা সময়ই বলে দিবে।
৫ দিন আগে শনিবার, এপ্রিল ১৯, ২০২৫